১) মনে পাপের চিন্তা জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথে ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম’ “বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি” পাঠ করা। আল্লাহ তাআলা এ মর্মে বলেন:
وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّـهِ ۚ
“আর যদি শয়তানের প্ররোচনা তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো।” (সূরা আ’রাফ: ২০০)
২) মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা। অর্থাৎ এই চিন্তা করা যে, আল্লাহর অবাধ্যতা করলে তিনি ক্রোধান্বিত হবেন এবং জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।
আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, পৃথিবীর কোনও মানুষ না দেখলেও আল্লাহর চোখকে কোনোভাবেই ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়। তিনি অবশ্যই বান্দার গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু দেখেন এবং প্রতিটি কর্ম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।
তাছাড়া আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত আমাদের কাঁধের ফেরেশতা দ্বয় আমাদের প্রতিটি কর্ম দিনরাত অবিরামভাবে লিখে চলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ كِرَامًا كَاتِبِينَ يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ
“অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর।” (সূর ইনফিতার: ১০, ১১ ও ১২)
৩) মহান আল্লাহর নিকট অন্তরের পরিশুদ্ধি ও আল্লাহ ভীতির জন্য দুআ করা।
যেমন: নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমদেরকে দুআ শিক্ষা দিয়েছেন:
اَللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا – اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ لَهَا
“হে আল্লাহ, তুমি আমার মনে তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) দান করো,
আমার মনকে পবিত্র কর,
তুমিই তো আত্মার পবিত্রতা দানকারী।
তুমিই তো হৃদয়ের মালিক ও অভিভাবক।”
“হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই
এমন ‘ইলম (জ্ঞান) থেকে যা কোনও উপকার দেয় না,
এমন হৃদয় থেকে যা (তোমার ভয়ে) ভীত হয় না,
এমন আত্মা থেকে যা পরিতৃপ্ত হয় না
এবং এমন দোয়া থেকে যা কবুল করা হয় না।”
(সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: দুআ, তওবা-ইস্তিগফার হা/২৭২২)
৪) মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। হাদিসে এসেছে, গুনাহরত অবস্থায় যদি মৃত্যু সংঘটিত হয় তাহলে কিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায় উত্তোলন করা হবে। (আল্লাহ ক্ষমা করুন)
যেমন: জাবির রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
يُبعَثُ كلُّ عبدٍ على ما مات عليه المُؤمِنُ على إيمانِه والمُنافِقُ على نِفاقِه
“প্রত্যেক বান্দাকে ঐ অবস্থায় কিয়ামতের দিন উঠানো হবে যে অবস্থার উপর সে মৃত্যু বরণ করেছে। মুমিনকে উঠানো হবে ঈমানের উপর এবং মুনাফিককে উঠানো হবে নিফাকির উপর।” ( সহীহ ইবনে হিব্বান,হা/৭৩১৩)
৫) মনে রাখতে হবে,পাপের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার ক্ষতি ও করুণ পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী। পাপের উন্মাদনা সাময়িক কিন্তু তার অনুতাপ দীর্ঘ মেয়াদি।
৬) কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন মুখস্থ, ইসলামী বই-পুস্তক পাঠ, নফল সালাত আদায় এবং বিভিন্ন ধরণের দুআ, জিকির, তাসবিহ, ইস্তিগফার ইত্যাদি পাঠ করা।
৭) নির্জন স্থান ত্যাগ করে মা, বাবা, ভাই, বোন, দ্বীনদার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সাথে অথবা ভালো কোনও আলেমের সান্নিধ্যে অথবা মসজিদে গিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করা। পরিবার থেকে দূরে থাকলে তাদের সাথে ফোনে কথা বলা বা ফোনে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের খোঁজ-খবর নেয়া অথবা দীর্ঘ দিন যোগাযোগ হয় নি এমন দীনী ভাই ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা।
৮) করতে ভালো লাগে এমন কোনও দুনিয়াবি উপকারী কাজ করা, শরীর চর্চা করা বা বাইরে খোলাস্থানে ঘুরতে যাওয়া। ঘরে চুপচাপ বসে বা শুয়ে থাকা ঠিক নয়। কারণ কথায় বলে: “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।”
৯) সিনেমা, নাটক ইত্যাদি দেখা, গান-বাদ্য শোনা বা অশ্লীল গল্প, উপন্যাস পাঠ করা থেকে দূরে থাকা। কারণ এগুলো মনের সুপ্ত বাসনা ও কু প্রবৃত্তিকে জাগ্রত করে।
অনুরূপভাবে যে সব উপকরণ হাতের কাছে থাকার কারণে পাপের দিকে মন ছুটে যায় সে সব উপকরণকে ঘর থেকে বের করা বা নষ্ট করে ফেলা।
১০) পাপের দিকে মনে প্রচণ্ড ঝোঁক সৃষ্টি হলেও ধৈর্য ধারণ করা এবং পাপ থেকে আত্ম সংবরণ করা ফরয। কেউ পাপ কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা করার পর যদি আল্লাহর ভয়ে তা পরিত্যাগ করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তার আমলনামায় গুনাহের পরিবর্তে সওয়াব লিপিবদ্ধ করে দেন। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
وإنْ هَمَّ بِسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كَتَبَهَا اللهُ تَعَالَى عِنْدَهُ حَسَنَةً كَامِلةً
“আর সে যদি কোনও পাপ করার সংকল্প করে; কিন্তু সে তা কর্মে বাস্তবায়িত না করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকট একটি পূর্ণ নেকি লিপিবদ্ধ করে দেন।” (সহিহ বুখারী হা/৬৪৯১ ও সহিহ মুসলিম হা/১৩১)
উল্লেখ্য যে, পাপকর্ম হয়ে গেলে করণীয় হল, অনতিবিলম্বে অনুতপ্ত হৃদয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া (নিবিষ্ট চিত্তে দু রাকআত নফল সালাত পড়ার পর আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার বা ক্ষমা চেয়ে দুআ করা অধিক উত্তম) এবং বেশি বেশি নেকির কাজ সম্পাদন করা।
(সংগৃহীত)
★প্রিয় প্রশ্নকারী দ্বীনি ভাই/বোন,
আপনাকে সত্যিকার অর্থে তওবা করতে হবে। আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। অতীতে যা করেছেন তার জন্য লজ্জিত হতে হবে। বেশি-বেশি দোয়া করতে হবে এবং কায়মনোবাক্যে আকুতি করতে হবে আল্লাহ যেন আপনাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি যেন আপনাকে এই বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পেতে সহায়তা করেন।
★একটু ভেবে দেখুন, কোন্ কোন্ পথে গোনাহ হয়ে যাচ্ছে। কোন্ কোন্ দরজা দিয়ে গোনাহ প্রবেশ করছে। ঘরের দরজা বন্ধ না করলে যেমন চোর ঢুকবে, তেমনি গোনাহের দরজা বন্ধ না করলেও অনিচ্ছায় আপনি গোনাহে জড়িয়ে পড়বেন। সুতরাং গোনাহের দরজা যদি বন্ধ করতে পারেন, তাহলে গোনাহ থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যাবে। আর যেসমস্ত পথে গোনাহ হয়ে যায় সেগুলো নিয়ে ভাবলে দেখবেন, তালিকার প্রথমেই আসবে অসৎ সঙ্গ বা খারাপ বন্ধু। সুতরাং যে কোনো মূল্যে আপনাকে অসৎ সঙ্গ থেকে বাঁচতে হবে। নইলে তারা আপনাকে গোনাহে জড়িয়েই ছাড়বে। এজন্যই তো প্রবাদ আছে, সৎ সঙ্গে সর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন– ‘মানুষ তার বন্ধুর দীনের উপর থাকে, অতঃপর কার সাথে বন্ধুত্ব করছ তা বিবেচনা করে নাও’। (সুনান তিরমিযী ২৩৭৮)
,
★গোনাহের আরেকটি দরজা হল, মোবাইল ও কম্পিউটার। এর সাথে সাথে ইন্টারনেট। এগুলো ভাল কাজেও ব্যবহার করা যায়, আবার এগুলো দিয়ে গোনাহও হয়ে যায়। প্রয়োজনের কথা বলে এগুলো হাতে আসে, আর তা দিয়ে প্রযুক্তির তুলনায় গোনাহই বেশি প্রবেশ করে। সুতরাং বাস্তবেই যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে এগুলোর নিরাপদ ব্যবহার করবেন। বিশেষ করে কম্পিউটারের বাস্তব প্রয়োজন হলে সেটা বাড়ির এমন স্থানে স্থাপন করবেন যেন সকলের নযরে পড়ে, আর আপনি গোনাহ থেকে বাঁচতে পারেন।
তিন: আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহন করুন। তাদের মজলিসে আসা যাওয়া করুন। এতে নফস নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাওবার উপর অটল থাকা আপনার জন্য সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবাহ ১১৯)
★ গোনাহ যদি যৌবনতাড়িত হয় তাহলে বিবাহের ব্যাপারে সিরিয়াসলি চিন্তা করুন। প্রয়োজনে আপনার গার্জিয়ানকে এ ব্যাপারে খোলাখুলি বলে বিবাহের আগ্রহ ব্যক্ত করতেও কোনো সমস্যা নেই।
★যদি বিবাহ সম্ভব না হয় তাহলে রোযা রাখুন।
★যখন গুনাহ করার মনস্কামনা সৃষ্টি হবে অথবা এই পাপে লিপ্ত হওয়ার জন্য শয়তানের ওয়াসওয়াসা অনুভূত হবে, তখন স্মরণ করবেন যে, আপনার এইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাল কিয়ামতের মাঠে আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ তাআলা বলেন–حَتَّى إِذَا مَا جَاؤُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدتُّمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنطَقَ كُلَّ شَيْءٍ
‘অবশেষে যখন তারা জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে, তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের চামড়া তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তখন তারা তাদের চামড়াকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ কেন? উত্তর দিবে,আল্লাহ আমাদেরকে বাকশক্তি দান করেছেন, যিনি বাকশক্তি দান করেছেন প্রতিটি জিনিসকে।’ (সূরা হা-মীম আসসাজদাহ্ : ২০,২১)
★কখনো একাকী নিভৃতে থাকবেন না। কেননা একাকীত্ব গোনাহ চিন্তা করার কারণ হতে পারে। আর আপনার সময়কে উপকারী বিষয়ে ব্যয় করতে সচেষ্ট হোন। যেমন- সৎকাজ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির, নামাজ ইত্যাদি।
★ পরকালের মুরাকাবা করুন। অর্থাৎ প্রতিদিন চোখ বন্ধ করে এই কথার ধ্যান করুন যে, এ দুনিয়ায় আমি চিরকাল থাকার জন্য আসিনি। অনেক বড় বড় রাজা-বাদশাহ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ এসেছিলেন, কিন্তু তারা আজ কবর জগতের বাসিন্দা। কেউ তাদের আজ খোঁজখবরটুকু নেয় না। যেই শরীর ও দেহ নিয়ে তারা গর্ব করেছিল মাটি ও পোকামাকড় তা খেয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। আমাকেও একদিন তাদের মতো হতে হবে। অতএব কী হবে এই দুনিয়ায় অহংকারী ও আত্মবিলাসী হয়ে অকারণে জুলুম-নির্যাতন করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে, সর্বোপরি ঈমান-আমলকে ঠিক না করে সে পথের অভিযাত্রী হয়ে।
(সংগৃহীত)