আইফতোয়াতে ওয়াসওয়াসা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না। ওয়াসওয়াসায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও করণীয় সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন

+1 vote
4,765 views
in সালাত(Prayer) by (102 points)
শাইখ নামাজে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে কি?বিস্তারিত জানতে চাই।

1 Answer

+1 vote
by (880 points)
edited by

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

 উত্তর-

 কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়,ইমামের পেছনে মুকতাদী সূরা ফাতেহা বা অন্য কোন সূরা পড়বে না। এর প্রমাণগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো :

জাহরী নামাযে ফাতেহা না পড়ার দলিল :

১.

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন

” وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون “

অর্থ: আর যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয়।

এ আয়াত সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য তাফসীরে তাবারী (৯খ. ১০৩পৃ.) ও তাফসীরে ইবনে কাসীরে (২খ. ২৮পৃ.) এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে-

وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون ” يعني في الصلاة المفروضة

অর্থ : যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয় অর্থাৎ ফরজ নামাযে।

হযরত ইবনে মাসঊদ রা. এর মতও তাই। তাফসীরে তাবারীতে বলা হয়েছে:

صلى ابن مسعود، فسمع أناسا يقرءون مع الامام، فلما انصرف، قال: أما آن لكم أن تفقهوا ؟ أما آن لكم أن تعقلوا ؟ وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا كما أمركم الله

অর্থাৎ হযরত ইবনে মাসঊদ রা. নামায পড়ছিলেন, তখন কতিপয় লোককে ইমামের সঙ্গে কেরাত পড়তে শুনলেন। নামায শেষে তিনি বললেন : তোমাদের কি অনুধাবন করার সময় আসেনি, তোমাদের কি বোঝার সময় হয় নি? যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং নীরব থাকবে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন। (৯ খ. ১০৩ পৃ.)

যায়দ ইবনে আসলাম ও আবুল আলিয়া র. বলেছেন:

كانوا يقرأون خلف الإمام فنزلت : { وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون }

অর্থাৎ তাঁরা (সাহাবীগণ) ইমামের পেছনে কেরাত পড়তেন, তখন অবতীর্ণ হয়

وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল র. বলেছেন:

أجمع الناس على أن هذه الآية في الصلاة

অর্থাৎ এবিষয়ে সকলেই একমত যে, উক্ত আয়াত নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। (মাসাইলে আহমদ লি আবী দাউদ, পৃ. ৪৮)

ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. লিখেছেন,

في قول الله عز وجل: {وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا} . مع إجماع أهل العلم أن مراد الله من ذلك في الصلوات المكتوبة أوضح الدلائل على أن المأموم إذا جهر إمامه في الصلاة أنه لا يقرأ معه بشيء وأنه يستمع له وينصت. التمهيد ١١/٣٠-٣١

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার এ বাণী {وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا} দ্বারা সকল আলেমের ঐকমত্যে আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো ফরজ নামায, এতে একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, ইমাম যখন নামাযে জোরে কেরাত পড়বেন তখন মুকতাদীরা কিছুই পড়বে না, বরং কান পেতে শুনবে ও চুপ থাকবে।

ইমাম ইবনে তায়মিয়া র. বলেছেন,

فَإِنَّ لِلْعُلَمَاءِ فِيهِ ثَلَاثَةَ أَقْوَالٍ . قِيلَ : لَيْسَ لَهُ أَنْ يَقْرَأَ حَالَ جَهْرِ الْإِمَامِ إذَا كَانَ يَسْمَعُ لَا بِالْفَاتِحَةِ وَلَا غَيْرِهَا وَهَذَا قَوْلُ الْجُمْهُورِ مِنْ السَّلَفِ وَالْخَلَفِ وَهَذَا مَذْهَبُ مَالِكٍ وَأَحْمَد وَأَبِي حَنِيفَةَ وَغَيْرِهِمْ وَأَحَدُ قَوْلَيْ الشَّافِعِيِّ . وَقِيلَ : بَلْ يَجُوزُ الْأَمْرَانِ وَالْقِرَاءَةُ أَفْضَلُ . وَيُرْوَى هَذَا عَنْ الأوزاعي وَأَهْلِ الشَّامِ وَاللَّيْثِ بْنِ سَعْدٍ وَهُوَ اخْتِيَارُ طَائِفَةٍ مِنْ أَصْحَابِ أَحْمَد وَغَيْرِهِمْ . وَقِيلَ : بَلْ الْقِرَاءَةُ وَاجِبَةٌ وَهُوَ الْقَوْلُ الْآخَرُ لِلشَّافِعِيِّ . وَقَوْلُ الْجُمْهُورِ هُوَ الصَّحِيحُ فَإِنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ قَالَ : { وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ } قَالَ أَحْمَد : أَجْمَعَ النَّاسُ عَلَى أَنَّهَا نَزَلَتْ فِي الصَّلَاةِ

অর্থাৎ এক্ষেত্রে আলেমগণের তিনটি মত রয়েছে। এক, কেউ কেউ বলেছেন, ইমাম যখন জোরে কেরাত পড়বেন আর মুকতাদী তা শুনবে তখন সে কোন কেরাতই পড়তে পারবে না। সূরা ফাতেহাও না, অন্য কোন সূরাও না।

পূর্বসুরী ও পরবর্তী যুগের অধিকাংশ আলেমের মত এটাই। ইমাম মালেক র.,ইমাম আহমাদ র. ও ইমাম আবূ হানীফা র. প্রমুখের মাযহাবও তাই। আর ইমাম শাফেয়ী র. এর দুটি মতের একটিও অনুরূপ।

অতঃপর অন্য দুটি মত উল্লেখ করার পর ইবনে তায়মিয়া র. আরও বলেন,অধিকাংশ আলেমের মতটিই সঠিক। কারণ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন,

وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

অর্থাৎ যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবন কর এবং নীরব থাক। তাহলে তোমাদের প্রতিও করুণা করা হবে। আর ইমাম আহমাদ বলেছেন, আয়াতটি সকলের মতে নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।

২.

হযরত আবূ মূসা আশআরী রা. বলেছেন,

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا قرأ الإمام فأنصتوا، فإذا كان عند القعدة فليكن أوّل ذكر أحدكم التشهد. أخرجه مسلم (৪০৪) في باب التشهد في الصلاة، وأحمد في المسند ৪/৪১৫ (১৯৯৬১)، وأبو داود (৯৭৩) وابن ماجه (৮৪৭) واللفظ له. ؟

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,যখন ইমাম কুরআন পড়বে,তোমরা তখন চুপ করে থাকবে। আর বৈঠকের সময় তাশাহহুদ-ই প্রথম পড়তে হবে।

(মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪০৪; আবূ দাউদ, হাদীস নং ৯৭৩; ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৮৪৭; মুসনাদে আহমাদ, ৪খ, ৪১৫ পৃ, হাদীস নং ১৯৯৬১। ইমাম আহমদ, (দ্র. তামহীদ ১১/৩৪), ইমাম মুসলিম, ইবনুল মুনযির (দ্র. আল আওসাত, ৩/১০৫), ইমাম ইবনে জারীর তাবারী র. (দ্র. তাফসীরে তাবারী, ৯/১০৩) ও ইবনে হাযম জাহেরী (দ্র. আল মুহাল্লা, ২/২৭০) প্রমুখ এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন।

হাফেজ ইবনে তায়মিয়াও তার মাজমুউল ফাতাওয়ায় ইমাম মুসলিমের সহীহ বলাকে সমর্থন করেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেছেন,এটি সহীহ হাদীস। (দ্র. ২/২৪২)

কেউ কেউ মনে করেন,কাতাদার শিষ্যদের মধ্যে সুলায়মান তায়মী একাই হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন। কাতাদার অন্যান্য শিষ্যদের বর্ণনায় একথাগুলো নেই। এর জবাব দুভাবে দেওয়া যায়।

এক.

ইমাম মুসলিম যেভাবে জবাব দিয়েছেন। তার এক ছাত্র হাদীসটি বর্ণনায় সুলায়মানের নিঃসঙ্গতার প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, ‘তুমি কি সুলায়মানের চেয়ে বড় হাফেজে হাদীস চাও?’ অর্থাৎ সুলায়মান একজন শীর্ষ হাফেজে হাদীস। তার নিঃসঙ্গ বর্ণনা গ্রহণযোগ্য না হলে আর কার বর্ণনা গ্রহণযোগ্যতা পাবে? তার চেয়ে বড় হাফেজে হাদীস পাওয়া তো দুস্কর।

দুই.

সুলায়মান নিঃসঙ্গ নন। দারাকুতনী ও বায়হাকীর বর্ণনায় সাঈদ ইবনে আবূ আরূবা ও উমর ইবনে আমের: দুজনই কাতাদা থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। (টীকা-১)

এমনিভাবে আবূ আওয়ানার বর্ণনায় আবূ উবায়দা মুজ্জাআ ইবনুয যুবায়র (দ্র. ১৮/২০) কাতাদা থেকে সুলায়মানের অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তিনজন সঙ্গী থাকতে সুলায়মানকে নিঃসঙ্গ ভাবা ঠিক নয়।

৩.

হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,

قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا وَإِذَا قَالَ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ فَقُولُوا رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ . رواه أبو داود والنسائي وابن ماجه وابن أبي شيبة من طريق أَبي خَالِدٍ عَنِ ابْنِ عَجْلاَنَ عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ عَنْ أَبِى صَالِحٍ عَنْه. وتابع أبا خالد محمد بن سعد الأشهلي أحد الثقات عند النسائي (٩٢٣) والدارقطني ١/٣٢٧ وتابعه أيضا محمد بن ميسر الصاغاني عند أحمد ٢/٣٧٦. وقد تعقب المنذري في تهذيب سنن أبي داود (৫৭৫) إعلال أبي داود بكلام طويل حاصله تصحيح هذه الزيادة والرد على من ضعّفه كأبي داود والدارقطني وإن مسلما صححها من حديث أبي موسى وأبي هريرة رضي الله عنهما.

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইমাম নিয়োগ করার উদ্দেশ্য তাকে অনুসরণ করা । সুতরাং সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তখন তাকবীর বলবে। আর যখন কুরআন পড়বে, তখন তোমরা নীরব থাকবে। যখন সে سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলবে, তখন তোমরা রাব্বানা লাকাল হামদ বলবে।

(আবূ দাউদ, হাদীস নং ৬০৪; নাসাঈ, হাদীস নং ৯২২-৯২৩; ইবনে মাজা, হাদীস নং ৮৪৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৮২০; মুসনাদে আহমদ, ২খ, ৩৭৬ পৃ; দারাকুতনী, ১খ, ৩২৭পৃ। ইমাম মুসলিম র. বলেছেন, هو عندي صحيح আমার দৃষ্টিতে এটি সহীহ। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪০৪)

ইমাম আবু দাউদের ধারণায় এ হাদীসে ‘যখন কেরাআত পড়া হয় তখন চুপ থাকবে’ কথাটি আবূ খালেদ আহমার একাই বর্ণনা করেছেন। তাই তিনি এটাকে আবূ খালেদের ভুল আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু নাসাঈ শরীফের বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনে সা’দ নাহশালীও একই উস্তাদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এটাকে আবূ খালেদের ভুল বলা ঠিক নয়। আবূ খালেদ ও নাহশালী দুজন তো বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। তারা দুজন ছাড়াও মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় মুহাম্মাদ ইবনে মুয়াছ্ছার একই উস্তাদ থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি যঈফ।

উল্লেখ্য, এই হাদীসটির শুরুতে বলা হয়েছে, إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ ইমাম নির্ধারণের উদ্দেশ্য হলো তাকে অনুসরণ করা। এ বাক্যটি বুখারী শরীফে হযরত আয়েশা রা. (হাদীস নং ৬৮৮) ও হযরত আনাস রা. (হাদীস নং ৩৭৮) থেকেও বর্ণিত হয়েছে।

এ বাক্যটি থেকেও প্রমাণিত হয় যে, মুকতাদী নীরব থাকবে। কেননা কুরআন পাঠকালে অনুসরণ কিভাবে করা হবে সে প্রসঙ্গে সূরা কিয়ামায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ (١٨) অর্থাৎ আমি যখন পাঠ করি আপনি তখন সেই পাঠের অনুসরণ করুন।

এই ‘অনুসরণ’ শব্দটির ব্যাখ্যা বুখারী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে: استمع له وأنصت (হাদীস নং ৫) অর্থাৎ কুরআন পাঠকালে অনুসরণ করার অর্থ হলো কান পেতে শোনা এবং নীরব থাকা।

সুতরাং কুরআন পড়ার সময় ইমামকে অনুসরণ করার অর্থও হবে তাই। এতটুকু কথা থেকে বিষয়টি বোঝা গেলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো স্পষ্ট করে এই দুই ও তিন নং হাদীসে বলে দিয়েছেন, ইমাম যখন কুরআন পড়বে তোমরা তখন চুপ করে থাকবে।

যদি মুকতাদীর উপর সূরা ফাতেহা পড়া ফরজ হতো তবে তিনি এখানেই স্পষ্ট করে বলে দিতেন: ইমাম যখন কুরআন পড়বে, তখন তোমরাও পড়ো। কিন্তু এ কথা তো এ হাদীসের কোন সূত্রেই আসে নি।

স্মর্তব্য, হযরত আবূ হুরায়রা রা. বর্ণিত এই হাদীসটির উপর ইমাম নাসায়ী র. অনুচ্ছেদ শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে :

باب تأويل قوله عز و جل {وإذا قرئ القرآن فاستمعوا له وأنصتوا لعلكم ترحمون {

অর্থ: অনুচ্ছেদ: আল্লাহর বাণী -যখন কুরআন পড়া হয় তখন মনোযোগের সাথে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়- এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। এই অনুচ্ছেদে উক্ত হাদীসটি উল্লেখ করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন এটি মূলত: উক্ত আয়াতেরই ব্যাখ্যা।

হাদীসটিতে যে কথা বোঝানো হয়েছে, আয়াতটিতেও তাই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নামাযে ইমামের কুরআন পড়ার সময় মুকতাদীকে চুপ থাকতে হবে।

৪.

হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ إِذَا قَالَ الْقَارِئُ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ. فَقَالَ مَنْ خَلْفَهُ آمِينَ . فَوَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ أَهْلِ السَّمَاءِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ . أخرجه مسلم في باب التسميع والتأمين (٤١٠) من طريق قُتَيْبَة بْنِ سَعِيدٍ عن يَعْقُوبَ- يَعْنِى ابْنَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ – عَنْ سُهَيْلٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْه. وقريب منه ما رواه البخاري بلفظ إذا أمن القاري فأمنوا فإن الملائكة تؤمن (٦٤٠٢) وأخرجه ابن ماجه في باب الجهر بآمين من طريق سفيان عن الزهري عن سعيد بن المسيب وأبي سلمة بن عبد الرحمن عنه نحو رواية مسلم (٨٥٢(

অর্থ: কুরআন পাঠকারী (অর্থাৎ ইমাম) যখন বলে غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ এবং যারা তার পেছনে, তারা (মুকতাদীরা ) বলে আমীন, যার আমীন বলা আসমান বাসী ( ফেরেশতা) দের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (মুসলিম শরীফ,হাদীস নং ৪১০)

ইমাম বুখারী র.ও স্বীয় সহীহ গ্রন্থে (হাদীস নং ৬৪০২) হাদীসটি এভাবে উল্লেখ করেছেন- কুরআন পাঠকারী যখন আমীন বলবে, তোমরাও তখন আমীন বলবে। কেননা ফেরেশতাগণও আমীন বলে থাকে। ইমাম ইবনে মাজা র.ও হাদীসটি মুসলিম শরীফের অনুরূপ উদ্ধৃত করেছেন। (হাদীস নং ৮৫১-৮৫২)

মুসলিম শরীফের হাদীস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়,জামাতের নামায সম্পর্কেই এ হাদীসটি বলা হয়েছে। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ইমামকেই কারী অর্থাৎ কুরআন পাঠকারী বলে অভিহিত করেছেন।

বোঝা গেল, নামাযে কুরআন পাঠ করা ইমামেরই কর্তব্য। যদি ইমাম ও মুকতাদী সবার জন্য কুরআন পাঠের বিধান থাকতো তবে শুধু ইমামকে এ বিশেষণে উল্লেখ করা হতো না।

উল্লেখ্য যে, ফজর মাগরিব ও এশা: এই তিন নামাযে ইমামকে স্বরবে কিরাআত পড়তে হয়। স্বরবে কিরাআতের উদ্দেশ্যই তো হলো, ইমাম পড়বেন, আর অন্যরা শুনবেন।

এখন যদি মুকতাদিকেও কিরাআত পড়তে হয়, তবে ইমামের স্বরব কিরাআতের কোন অর্থ হয় না। শ্রবণকারী না থাকলে ইমাম জোরে কিরাআত পড়বেন কেন, লাউডস্পিকার বা মাইকই বা ব্যবহার করবেন কেন?

৫.

হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,

ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال إذا قال الامام غير المغضوب عليهم ولا الضالين فقولوا آمين فانه من وافق قوله قول الملائكة غفر له ما تقدم من ذنبه. أخرجه البخاري (٧٨٢

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইমাম যখন غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলবে, তোমরা তখন আমীন বলো। কেননা যার আমীন বলা ফেরেশতা আমীন বলার সঙ্গে মিলে যাবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৭৮২

এই হাদীস থেকেও বোঝা যায়,মুকতাদী সূরা ফাতেহা পাঠ করবে না। কারণ-

এক,

মুকতাদী সূরা ফাতেহা পাঠে ব্যস্ত থাকলে ইমাম কখন غير المغضوب عليهم ولا الضالين পড়ছেন তা খেয়াল রাখা সম্ভব হবে না। ফলে যথাসময়ে আমীন বলাও হয়ে উঠবে না।

সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিকে মুকতাদীকে ইমামের غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলার প্রতি খেয়াল রাখতে বলবেন, অপরদিকে সূরা ফাতেহা পাঠের আদেশ দিয়ে তাকে ব্যস্ত করে রাখবেন, এমনটা হতে পারে না।

দুই,

যে মুকতাদী নামায শুরুর কিছুক্ষণ পর এসে শরীক হল,সে যদি সূরা ফাতেহা পাঠ শুরু করে দেয়,আর ইতিমধ্যেই ইমাম غير المغضوب عليهم ولا الضالين বলে ফেলেন,তবে সেই মুকতাদী কি করবে?

যদি সে তার পড়াই চালু রাখে তাহলে ইমামের সঙ্গে তার আমীন বলা হলো না। অথচ এ হাদীসে তাকে ইমামের সঙ্গে আমীন বলতে বলা হয়েছে। আর যদি সে তার পড়া বন্ধ করে দিয়ে ইমামের সঙ্গে আমীন বলে, এরপর অবশিষ্ট অংশ পাঠ করে তবে তার আমীন ‘মোহর’ হবে না।

অথচ আবূ দাউদ শরীফের হাদীসে (হাদীস নং ৯৩৮) বলা হয়েছে আমীন মোহরের ন্যায় ( مثل الطابع على الصحيفة )। জানা কথা, সিলমোহর শেষেই হয়ে থাকে। তাছাড়া আমীন শব্দটি কুরআনের আয়াত নয়। তাই সূরা ফাতেহার মাঝখানে আমীন বলার অর্থ – কুরআন নয় এমন কিছুকে কুরআনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া।

এসব কারণে অনেক মুহাদ্দিস এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, মুকতাদি ফাতেহা পড়বে না। ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. তাঁর তামহীদ গ্রন্থে বলেছেন,

এই হাদীসে একথার নির্দেশ রয়েছে যে, ইমাম যদি স্বশব্দে কেরাত পড়ে থাকেন তবে মুকতাদি তার পেছনে কেরাত পড়বে না। সূরা ফাতেহাও না, অন্য কোন সূরাও না। কারণ তাদের উপর যদি কেরাত পড়া আবশ্যক হতো, তাহলে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হতো, প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ ফাতেহা পাঠ শেষে আমীন বলে।

কেননা যে ব্যক্তিই সূরা ফাতেহা পাঠ করে তার জন্যই সুন্নত হলো সেটি পাঠ সমাপ্ত করে আমীন বলা। আর একথাও সকলের জানা যে, মুকতাদি যদি ইমামের পেছনে সূরা পাঠে ব্যস্ত থাকে তবে তার পক্ষে ইমামের ফাতেহা পাঠ কখন শেষ হলো সেদিকে খেয়াল রাখা খুবই দুস্কর।

এমতাবস্থায় তাকে ইমাম সাহেবের ولا الضالين বলার সময় আমীন বলার নির্দেশ দেওয়া হবে, আবার ইমামের পাঠ থেকে অন্যমনস্ক থাকারও নির্দেশ দেওয়া হবে তা হতে পারে না। (তামহীদ, সুমাই এর ৩ নং হাদীস)

একইভাবে হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী রহ. তার ফাতহুল বারী গ্রন্থে লিখেছেন,

মুকতাদিকে যখন ইমামের কেরাত মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলা হলো এবং ইমামের ফাতেহা পাঠ শেষে তার দোয়ার উপর আমীন বলতে নির্দেশ দেওয়া হলো, এতে প্রমাণিত হলো যে, মুকতাদির উপর কেরাত পড়ার দায়িত্ব নেই। কেননা সে যখন মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করলো এবং তার দোয়ার উপর আমীন বললো, তখন ধরে নিতে হবে যে, সে নিজেও দোয়া করলো। যেমন পূর্বসূরিগণের অনেকেই বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামকে বলেছেন: তোমাদের দু’জনের দোয়াই কবুল করা হলো, তাঁরা বলেছেন, আসলে মূসা আ.ই দোয়া করেছিলেন, আর হারূন আ. আমীন আমীন বলেছিলেন। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা দুজনকেই দোয়াকারী আখ্যা দিয়েছেন। (৪/২২৭)

৬.

হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করলেন, যে নামাযে তিনি উচ্চস্বরে কেরাত পড়েছিলেন। অতঃপর বললেন, তোমাদের কেউ কি একটু পূর্বে আমার সঙ্গে কুরআন পড়েছে? তখন একজন বললেন, হ্যাঁ, আমি পড়েছি ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাইতো বলছি আমার সঙ্গে কুরআন নিয়ে টানাটানি হচ্ছে কেন? লোকেরা যেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একথা শুনলেন, সেদিন থেকে সেসব নামাযে কুরআন পড়া ছেড়ে দিলেন, যেসব নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চস্বরে কুরআন পড়তেন।

মুয়াত্তা মালেক, পৃ,২৯; তিরমিযী, হাদীস নং ৩১২, তিনি এটিকে হাসান বলেছেন। আবূ দাউদ, হাদীস নং ৮২৬; নাসায়ী, হাদীস নং ৯১৯; মুসনাদে আহমদ, ৪খ, ২৮৪পৃ; ইবনে মাজা, হাদীস নং ৮৪৮, ৮৪৯।

অনুচ্চস্বরে পড়া নামাজে সূরা ফাতিহা পড়া

১.

হযরত জাবির রা. বলেছেন,

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,যে ব্যক্তির ইমাম আছে,তার ইমামের কেরাতই তার কেরাত বলে গণ্য হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা,হাদীস নং ৩৮২৩) এ সনদটি সহীহ।

মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমায়দে ভিন্ন সনদে এটি উদ্ধৃত হয়েছে। বূসিরী র. বলেছেন, এটি ইমাম মুসলিম এর শর্ত মোতাবেক সহীহ। আহমদ ইবনে মানী’ অন্য একটি সনদে তার মুসনাদ গ্রন্থে এটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম বূসিরী বলেছেন, এটি বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত মোতাবেক সহীহ। (দ্র, শায়খ মুহাম্মদ আওওয়ামা কৃত মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বার টীকা)

মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ, পৃ ৯৮; মুসনাদে আহমদ, ৩খ, ৩৩৯পৃ; (এ সনদ দুটিও সহীহ)। ইবনে মাজাহ শরীফ, হাদীস নং ৮৫০। এতে জাবের জু’ফী রয়েছে।

এ হাদীসে মুলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে, মুকতাদীর জন্য আলাদা করে সূরা ফাতেহা বা অন্য কোন সূরা পড়ার প্রয়োজন নেই। বরং ইমামের কেরাতই তার জন্য যথেষ্ট হবে।

কেননা সূরা ফাতেহা হলো আল্লাহর দরবারে হেদায়াতের আবেদন। সকলের পক্ষ থেকে আবেদন একজনই পেশ করে। ইমামকেই সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রুকু, সেজদা, তাকবীর ও তাসবীহ হলো উক্ত দরবারের আদব। এজন্য এগুলো সকলকে পালন করতে হয়।

২.

হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলেছেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমরা সেজদায় থাকাবস্থায় যদি তোমরা নামাযে শরীক হও তবে তোমরাও সেজদা করবে। সেটাকে কিছু গণ্য করবে না। যে ব্যক্তি রুকু পেল সে নামায (অর্থাৎ ঐ রাকাত ) পেল। আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস নং ৮৯৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, ২/২৮১।

এ হাদীস থেকেও বোঝা গেল,মুকতাদীর ফাতেহা পড়ার প্রয়োজন নেই । ইমামের সঙ্গে রুকু পেলেই তার রাকাত পূর্ণ হবে।

৩.

হযরত আবূ বাকরা রা. বলেছেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকুতে থাকাবস্থায় তিনি এসে পৌঁছলেন,এবং কাতারে যাওয়ার পূর্বেই রুকুতে চলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তিনি ব্যাপারটি জানালে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিন। তবে এমনটি আর করো না। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং : ৭৮৩)

ইমাম বুখারী কিতাবুল কিরাআতে ও তাবারানী (দ্র, ফাতহুল বারী) একথাও উল্লেখ করেছেন যে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন,এমন কে করেছ? তিনি বললেন,আপনার সঙ্গে আমার এ রাকাতটি ছুটে যাওয়ার আশংকা করেছিলাম (তাই আমি এমনটি করেছি)।

এ হাদীসটি থেকে বোঝা গেল,রুকু পেলেই মুকতাদীর রাকাত পূর্ণ হয়, এবং সূরা ফাতেহা পড়া মুকতাদীর জন্য ফরজ নয়। অন্যথায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ বাকরা রা.কে পুনরায় নামায পড়তে বলতেন।

ইমাম বায়হাকী হযরত যায়দ ইবনে ছাবিত রা. থেকেও আবূ বাকরা রা.এর অনুরূপ ঘটনা উল্লেখপূর্বক বলেছেন,

وفي ذلك دليل على إدراك الركعة ولولا ذلك لما تكلفوه

অর্থাৎ এ থেকে প্রতীয়মান হয়,রুকু পেলেই রাকাত পাওয়া হয়। অন্যথায় তারা এমন তড়িঘড়ি করতেন না। (সুনানে বায়হাকী,২খ, ৯০পৃ)

মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে হযরত যায়দ ইবনে ছাবিত রা. ও হযরত ইবনে উমর রা. উভয় থেকে এই ফতোয়া বর্ণিত হয়েছে –

الرجل إذا انتهى إلى القوم وهم ركوع أن يكبر تكبيرة وقد أدرك الركعة وإن وجدهم سجودا سجد معهم ، ولم يعتد بذلك .

অর্থাৎ নামাযে আগত ব্যক্তি যদি দেখে, জামাত রুকু অবস্থায় রয়েছে, তবে তাকবীর দিয়ে নামাযে শরীক হবে। এতে করে সে রাকাতটি পেয়ে যাবে। কিন্তু তাদেরকে সেজদা অবস্থায় পেলে সেজদা করবে বটে, তবে সেটাকে রাকাতরূপে গণ্য করবে না। (দ্র, ২খ, ২৭৮ পৃ)

আব্দুর রাযযাক স্বীয় মুসান্নাফে (২খ,২৮১পৃ) ইবনুল মুনযির তার আওসাত গ্রন্থে (২০২৫) ও ইমাম তাবারানী আলমুজামুল কাবীরে (৯৩৫১) হযরত আলী রা. ও ইবনে মাসউদ রা.এর এই ফতোয়া উদ্ধৃত করেছেন,

من لم يدرك الركعة فلا يعتد بالسجدة

অর্থাৎ যে ব্যাক্তি রুকু পেল না সে যেন সেজদা করেই সেটাকে রাকাত গণ্য না করে। হায়ছামী র. বলেছেন, رجاله موثقون এর বর্ণনাকারীগণকে বিশ্বস্ত বলা হয়েছে। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ২৪০২)

উক্ত দুটি গ্রন্থে ও তাহাবী শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে,

‘যায়দ ইবনে ওয়াহব র. বলেন, আমি ও ইবনে মাসউদ রা. মসজিদে প্রবেশ করলাম। ইমাম তখন রুকুতে ছিলেন। আমরা রুকু করে হেঁটে হেঁটে কাতারে পৌঁছলাম। ইমাম নামায শেষ করলে আমি রাকাতটি পড়বার জন্য দাঁড়াতে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, তুমি তো রাকাত পেয়ে গেছ। হায়ছামী বলেন,এর বর্ণনাকারীরা বিশ্বস্ত। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৩৩৮১; মুজামে কাবীর : ৯৩৫৪); তাহাবী : ২৩২২)

বুখারী শরীফের পূর্বোক্ত হাদীস ও সাহাবীগণের এসব ফতোয়ার প্রেক্ষিতে অধিকাংশ আলেম এই মত পোষণ করতেন যে, যে ব্যক্তি রুকু পেল সে রাকাত পেয়ে গেল।

হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী র. তাঁর ফাতহুল বারী নামক বুখারী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থে লিখেছেন,

যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে রুকু করতে পারল সে ঐ রাকাত পেয়ে গেল, যদিও ইমামের সঙ্গে তার কিয়াম (দাঁড়ানো ) ও ফাতেহা পাঠ ছুটে গেল। এটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের মত ।

ইমাম ইসহাক র. (ইমাম বুখারীর উস্তাদ) প্রমুখ এটাকে আলেমগণের ইজমা বা ঐকমত্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু তালিব এর বর্ণনানুসারে ইমাম আহমদ র. বলেছেন যে,এ ব্যাপারে কোন মুসলমানের দ্বিমত নেই।

অথচ তাঁর অবগতি ছিল ব্যাপক,ইলমের ক্ষেত্রে তাঁর সতর্কতা ও পরহেজগারী ছিল চরম পর্যায়ের। এ মতই পোষণ করতেন হযরত আলী রা., ইবনে মাসউদ রা., ইবনে উমর রা., যায়দ ইবনে ছাবিত রা. ও এক বর্ণনানুসারে হযরত আবূ হুরায়রা রা. । আব্দুর রাহমান ইবনে ইসহাক আল মাদীনী র. সাঈদ আল মাকবূরী’র সুত্রে হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। (দ্র. ৪খ. ২৩০ পৃ.)

রুকু পেলে রাকাত পাওয়া হয় উম্মতের এই সর্বসম্মত মত দ্বারাই ইমাম আহমদ প্রমাণ করেছেন যে,মুকতাদির উপর কেরাত পড়া ফরজ নয়। তার পুত্র আব্দুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, فإن صلى خلف الإمام ولم يقرأ بشيء অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি মুকতাদি হয় এবং কোরআনের কোন অংশই না পড়ে? তিনি উত্তরে বললেন,

يجزيه وذلك أنه لو أدرك الإمام وهو راكع فلم يعلم الناس اختلفوا أنه إذا ركع مع الإمام أن الركعة تجزئه وإن لم يقرا (رقم ২৭৮)

অর্থাৎ তার নামায হয়ে যাবে। কেননা যদি সে ইমামকে রুকু অবস্থায় পেয়ে তার সঙ্গে রুকু করে তবে কেরাত না পড়লেও যে তার নামায হয়ে যাবে তাতে কারো দ্বিমত আছে বলে জানা যায় না। (নং ২৭৮)

মোট কথা,বুখারী শরীফের হাদীস,সাহাবীগণের ফতোয়া ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের উল্লিখিত মত থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে,সূরা ফাতেহা পাঠ করা মুকতাদীর জন্য অপরিহার্য নয়। অন্যথায় রুকু পেলে রাকাত পাওয়া হয়নি বলে ফতোয়া দেওয়া হতো।

৪.

আতা ইবনে ইয়াসার র. বলেছেন,

أَنَّهُ سَأَلَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ الإِمَامِ فَقَالَ لاَ قِرَاءَةَ مَعَ الإِمَامِ فِى شَىْءٍ . أخرجه مسلم (٥٧٧) في باب سجود التلاوة. والنسائي في باب ترك السجود في النجم. (٩٦٠)

অর্থ: তিনি ইমামের সঙ্গে কুরআন পড়া সম্পর্কে যায়দ ইবনে ছাবিত রা.কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জবাব দিলেন, কোন নামাযেই ইমামের সঙ্গে কোন কিছু পড়বে না। মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৫৭৭, নাসাঈ শরীফ (৯৬০), আবু আওয়ানা (১৯৫১), বায়হাকী (২৯১১)।

৫.

নাফে র. থেকে বর্ণিত:

أن عبد الله بن عمر كان إذا سئل هل يقرأ أحد خلف الإمام قال إذا صلى أحدكم خلف الإمام فحسبه قراءة الإمام وإذا صلى وحده فليقرأ قال وكان عبد الله بن عمر لا يقرأ خلف الإمام. موطا مالك صـ ٢٩

অর্থ: হযরত ইবনে উমর রা.কে যখন জিজ্ঞেস করা হতো, ইমামের পেছনে কুরআন পড়া যাবে কিনা? তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন ইমামের পেছনে নামায পড়ে তখন ইমামের পড়াই তার জন্য যথেষ্ট হয়। আর যখন একাকী পড়ে, তখন যেন নিজেই কেরাত পড়ে। নাফে বলেন, ইবনে উমর রা. ইমামের পেছনে কুরআন পড়তেন না। (মুয়াত্তা মালেক, পৃ২৯, (৪৩), আব্দুর রাযযাক (২৮১৪), মুসনাদে ইবনুল জাদ (১১৫০), তাহাবী (১৩১২, ১৩১৭) দারাকুতনী (১৫০৩), বায়হাকী (২৯০১, ২৯০৩)।

৬.

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর ফতোয়া:

عن أبي وائل : جاء رجل إلى عبد الله فقال: اقرأ خلف الإمام؟ فقال له عبد الله إن في الصلاة شغلا وسيكفيك ذلك الإمام

আবু ওয়াইল রহ. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ইমামের পেছনে কেরাত পড়বো? তিনি বললেন, নামাযে খুবই মগ্নতা আছে। কেরাত পড়ার জন্য ইমামই তোমার পক্ষে যথেষ্ট। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা (৩৭৮০), মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক (২৮০৩), তাহাবী (১৩০৭), তাবারানী কৃত আল আওসাত (৪০৪৯), মুজামে কাবীর (৯৩১১)

৭.

হযরত জাবির রা. বলেছেন,

من صلى ركعة لم يقرأ فيها بأم القرآن فلم يصل إلا أن يكون وراء الإمام. أخرجه الترمذي (٣١٣) وقال هذا حديث حسن صحيح ومالك في الموطا صـ ٢٨

অর্থ: যে ব্যক্তি নামাযের কোন রাকাতে সূরা ফাতেহা পড়ল না, সে যেন নামাযই পড়ল না। তবে যদি সে ইমামের পেছনে নামায পড়ে। (তাহলে তার ব্যাপার ভিন্ন।) তিরমিযী, হাদীস নং ৩১৩; তিনি এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। মুয়াত্তা মালেক, পৃ ২৮, নং ৩৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক (২৭৪৫) মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা (৩৬২১), আল কিরাআতু খালফাল ইমাম লিল বুখারী (১৭৪), নাসাঈ কুবরা (২৮৯৯), শারহু মুশকিলিল আছার (১৩০১), বায়হাকী (১২৪২), মারিফাতুস সুনান ওয়াল আছার (৩২০৩) আল কিরাআতু খালফাল ইমাম লিল বায়হাকী (৩৫৮)

এ হাদীসে জাবির রা. স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন, সূরা ফাতেহা পড়া ইমাম বা একাকী নামায আদায়কারীর জন্য আবশ্যক। মুক্তাদীর জন্য সেটা আবশ্যক নয়। এ কথা দ্বারা তিনি যেন উবাদা ইবনুস সামেত রা. কর্তৃক বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদীসের ব্যাখ্যা করে দিলেন,যে হাদীসে তিনি বলেছেন,যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ে নাতার নামাযই হয় না। এ বিধানটি মুক্তাদির জন্য নয়। ইমাম বা একা নামায আদায়কারীর জন্য। আবূ দাউদ শরীফে সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না র. থেকেও অনুরূপ কথা উদ্ধৃত হয়েছে।

হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রা. কর্তৃক বর্ণিত ঐ হাদীসটি বর্ণনা করার পর আবূ দাউদ র. বলেন, قال سفيان : لمن يصلي وحده অর্থাৎ সুফিয়ান র. বলেছেন, একা নামায আদায়কারীর ক্ষেত্রে এই হাদীস। (দ্র, হাদীস নং ৮২২)

ইমাম তিরমিযী র. ইমাম আহমাদ থেকেও একই কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

واما أحمد بن حنبل فقال معنى قول النبي صلى الله عليه وسلم لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب إذا كان وحده

অর্থাৎ আহমাদ র. বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বলেছেন সূরা ফাতেহা ছাড়া নামায হয় না এটা তখন, যখন কেউ একা নামায পড়ে। ইমাম আহমাদ র. এক্ষেত্রে জাবির রা. এর উল্লিখিত হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করে বলেন,

فهذا رجل من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم تأول قول النبي صلى الله عليه وسلم لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب أن هذا إذا كان وحده

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথার ‘যে সূরা ফাতেহা পড়েনি তার নামায হয়নি’ এ ব্যাখ্যা করেছেন যে,এটা তার ক্ষেত্রে যে একা নামায আদায় করে।

ইমাম তিরমিযীও হযরত উবাদা রা. এর হাদীসটিকে মুকতাদীর বিধান বলে মনে করতেন না। এই কারণে ‘কিরাআত খালফাল ইমাম’ বা মুকতাদীর জন্য কেরাত পড়া অনুচ্ছেদে হাদীসটি উল্লেখ না করে তিনি এর ঊনচল্লিশ অনুচ্ছেদ পূর্বে ما جاء أنه لا صلاة إلا بفاتحة الكتاب অনুচ্ছেদে নামাযে ফাতেহার কি গুরুত্ব সেটা বোঝাবার জন্য উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আহমাদ র. জোর দিয়ে বলেছেন,

ইমাম যখন উচ্চস্বরে কেরাত পড়ে, তখন তার পেছনে মুকতাদী যদি কেরাত না পড়ে তবে মুকতাদীর নামায হবে না: এমন কথা আহলে ইসলামের কাউকে আমরা বলতে শুনিনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবীগণ, ও তাবেয়ীগণ, মদীনাবাসীদের মধ্যে ইমাম মালেক, ইরাকবাসীদের মধ্যে সুফিয়ান ছাওরী, শামবাসীদের মধ্যে ইমাম আওযায়ী, ও মিসরবাসীদের মধ্যে লায়ছ ইবনে সা’দ, এঁদের কেউই একথা বলেননি – ইমাম যখন কুরআন পড়বে, তখন পেছনে মুকতাদী যদি না পড়ে তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। (ইবনে কুদামা কৃত আল-মুগনী, ১খ, ৩৩০পৃ, বিস্তারিত জানতে হযরত মাওলানা আব্দুল মতিন দা.বা. রচিত প্রামাণিক গ্রন্থ দলিলসহ নামাজের মাসায়েল দ্রষ্টব্য)

আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।

উত্তর প্রদান

মুফতী মুহাম্মাদ মাহবুবুল হাসান

ফাতওয়া বিভাগ, IOM

by

ইমামের পেছনে সালাতে সূরা ফাতিহাও পাঠ করাও জায়েয আছে।

আল্লাহ বলেন,

"যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ কর এবং নিশ্চুপ হয়ে থাক; যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।" (সূরা আ'রাফ:২০৪)

এ আয়াতে কুরআনের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে তেলাওয়াতকালে চুপ থাকা ও মনোযোগসহকারে শ্রবণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কাফিরদের মত হট্টগোল করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের সম্পর্কে বলেন:

"অবিশ্বাসীরা (কাফিররা) বলে, ‘তোমরা এ কুরআন শ্রবণ করো না এবং তা আবৃত্তিকালে শোরগোল সৃষ্টি কর; যাতে তোমরা জয়ী হতে পার।’ [সূরা ফুসসিলাত(হা-মীম সাজদাহ) ৪১ নং সূরা:২৬ নং আয়াত]


নাবী (সাঃ) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন মক্কার কাফিররা তখন হট্টগোল সৃষ্টি করতো যাতে কেউ না শুনতে পায়। 

মনোযোগসহকারে শ্রবণ করা আর চুপ থাকার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- চুপ থাকা হল: বাহ্যিক কথাবার্তা ও অন্যান্য ব্যস্ততা বর্জন করা, যা কুরআন শ্রবণে বাধা সৃষ্টি করে। আর মনোযোগসহকারে শ্রবণ করা হল: অন্তরের উপস্থিতিসহ একাগ্রচিত্তে শ্রবণ করা ও শ্রুত বিষয়কে অনুধাবন করা। কুরআন তেলাওয়াত বা শ্রবণকালে এ দু’টি আবশ্যিক বিষয়। তাহলেই আল্লাহ তা‘আলার রহমত পাওয়ার আশা করা যায়। যে ব্যক্তিই কুরআন তেলাওয়াত শুনবে সে সকল ব্যক্তি এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। সালাতের ভিতর হোক আর বাইরে হোক।

সুতরাং সালাতেও ইমাম যখন কুরআন তেলাওয়াত করবে তখন মুক্তাদির চুপ থাকা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: 

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ইমাম নিযুক্ত করা হয়েছে তাঁর অনুসরণ করার জন্য। অতএব, যখন সে তাকবীর বলে তখন তোমরাও তাকবীর বল, আর যখন সে কুরআন পড়ে তখন তোমরা চুপ থাকবে, আর যখন তিনি বলেন, ‘সামি’আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ তখন তোমরা বলবে, ‘রাব্বানা লাকাল হামদ’।(সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৯২১, হা.স.)

নাবী (সাঃ) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন মক্কার কাফিররা তখন হট্টগোল সৃষ্টি করতো যাতে কেউ না শুনতে পায়। 

মনোযোগসহকারে শ্রবণ করা আর চুপ থাকার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- চুপ থাকা হল: বাহ্যিক কথাবার্তা ও অন্যান্য ব্যস্ততা বর্জন করা, যা কুরআন শ্রবণে বাধা সৃষ্টি করে। আর মনোযোগসহকারে শ্রবণ করা হল: অন্তরের উপস্থিতিসহ একাগ্রচিত্তে শ্রবণ করা ও শ্র“ত বিষয়কে অনুধাবন করা। কুরআন তেলাওয়াত বা শ্রবণকালে এ দু’টি আবশ্যিক বিষয়। তাহলেই আল্লাহ তা‘আলার রহমত পাওয়ার আশা করা যায়। যে ব্যক্তিই কুরআন তেলাওয়াত শুনবে সে সকল ব্যক্তি এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। সালাতের ভিতর হোক আর বাইরে হোক।

তবে অবশ্যই সকলকে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে। কেননা সূরা ফাতিহা ছাড়া কারো সালাত হবে না। অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। (তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ)

এখানে ঐ সকল কাফেরদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যারা কুরআন তিলাঅতের সময় চেঁচামেচি করত এবং সঙ্গী-সাথীদের বলত, {لَا تَسْمَعُوا لِهَذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ} অর্থাৎ, তোমরা কুরআন শ্রবন করো না এবং তা আবৃতিকালে শোরগোল কর। (সূরা ফুসসিলাত (হা-মীম সাজদাহ )৪১;২৬) তাদেরকে বলা হল যে, এর পরিবর্তে তোমরা যদি মন দিয়ে শোন ও নীরব থাক, তাহলে হয়তো বা তোমাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দান করবেন এবং সেই সাথে তোমরা আল্লাহর দয়া ও রহমতের অধিকারী হয়ে যাবে। কোন কোন ইমাম এটিকে সাধারণ আদেশ বলে ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ, যখনই কুরআন পাঠ করা হবে; নামাযে হোক বা নামাযের বাইরে তখনই সকলকেই নীরব থেকে কুরআন শ্রবণ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই সাধারণ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সশব্দে ক্বিরাআত পড়া হয়, এমন সমস্ত নামাযে মুক্তাদীদের সূরা ফাতিহা পাঠ কুরআনের এই আদেশের পরিপন্থী বলেছেন। পক্ষান্তরে অন্যান্য ইমামদের মত হল, সশব্দে ক্বিরাআত পড়া হয়, এমন নামাযে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করার ব্যাপারে নবী (সাঃ) তাকীদ করেছেন, যা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাঁদের নিকট এই আয়াত শুধুমাত্র কাফেরদের জন্য মনে করাই সঠিক। যেমন এই সূরার মক্কী হওয়ার মধ্যেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু যদি এটিকে সাধারণ আদেশ মেনে নেওয়া যায়, তবুও নবী (সাঃ) এই সাধারণ আদেশ হতে মুক্তাদীদেরকে আলাদা করে নিয়েছেন। আর এভাবে কুরআনের এই আদেশ সত্ত্বেও মুক্তাদীদের সশব্দে ক্বিরাআতবিশিষ্ট নামাযেও সূরা ফাতিহা পাঠ করা আবশ্যিক হবে। কারণ কুরআনের এই সাধারণ আদেশ থেকে সূরা ফাতিহা পাঠ করার আদেশ সহীহ মজবূত হাদীস দ্বারা ব্যতিক্রান্ত। যেমন অন্য কিছু ক্ষেত্রে কুরআনের ব্যাপক আদেশকে সহীহ হাদীস দ্বারা নির্দিষ্ট করে নেওয়া স্বীকৃত। যেমন, (الزَّانِيَةُ والزَّانِي فَاجلِدُوا) এর ব্যাপক আদেশ হতে বিবাহিত ব্যভিচারীকে আলাদা বা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অনুরূপ (والسَّارِقُ وَالسَّارِقة) এর ব্যাপক আদেশ হতে এমন চোরকে আলাদা বা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, যে দীনারের এক চতুর্থাংশের কম মাল চুরি করেছে অথবা চুরির মাল যথেষ্ট হিফাযতে ছিল না ইত্যাদি। অনুরূপ (فَاستَمِعُوا لَهُ وأَنصِتُوا) এর ব্যাপক আদেশ হতে মুক্তাদীদেরকে আলাদা বা নির্দিষ্ট করে নেওয়া হবে। সুতরাং তাদের সশব্দে ক্বিরাআত হয় এমন সকল নামাযেও সূরা ফাতিহা পাঠ করা জরুরী হবে। কারণ নবী (সাঃ) এর তাকীদ দিয়েছেন। যেমন সূরা ফাতিহার তফসীরে ঐ সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে।(তাফসীরে আহসানুল বায়ান)


সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ সংক্রান্ত অনেকেই মতভেদের বেড়াজালে পড়ে যান।  মতভেদ ঘটলে আমাদের করনীয় :

আল্লাহ বলেন:-

"হে বিশ্বাসিগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসূল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (ও উলামা)দের অনুগত হও।আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (সূরা নিসা:৫৯)


সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ প্রসঙ্গ:

ইসহাক ইবনু ইবরাহীম আল হানযালী (রহঃ) ..... আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল অথচ তাতে উন্মুল কুরআন (সূরাহ ফা-তিহাহ্) পাঠ করেনি তার সালাত ত্রুটিপূর্ণ থেকে গেল, পূর্ণাঙ্গ হল না। এ কথাটা তিনবার বলেছেন। আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, আমরা যখন ইমামের পিছনে সালাত আদায় করব তখন কী করব? তিনি বললেন, তোমরা চুপে চুপে তা পড়ে নাও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, মহান আল্লাহ বলেছেনঃ আমার এবং আমার বান্দার মাঝে আমি সালাতকে অর্ধেক অর্ধেক করে ভাগ করে নিয়েছি এবং আমার বান্দার জন্য রয়েছে সে যা চায়। বান্দা যখন বলে, الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য), আল্লাহ তা'আলা তখন বলেনঃ আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। সে যখন বলে, الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (তিনি অতিশয় দয়ালু এবং করুণাময়); আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ বান্দা আমার প্রশংসা করেছে, গুণগান করেছে। সে যখন বলে, مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (তিনি বিচার দিনের মালিক), তখন আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে আল্লাহ আরো বলেনঃ বান্দা তার সমস্ত কাজ আমার উপর সমর্পণ করেছে। সে যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ (আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি) তখন আল্লাহ বলেন। এটা আমার এবং আমার বান্দার মধ্যকার ব্যাপার। (এখন) আমার বান্দার জন্য রয়েছে সে যা চায়। যখন সে বলে,اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ * صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ (আমাদের সরল-সঠিক পথে পরিচালনা করুন। যেসব লোকদের আপনি নি'আমাত দান করেছেন, তাদের পথে নয় যাদের প্রতি আপনার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে; )তখন আল্লাহ বলেনঃ এসবই আমার বান্দার জন্যে এবং আমার বান্দার জন্যে রয়েছে সে যা চায়।

সুফইয়ান বলেন, আমি 'আলা ইবনু আবদুর রহমান ইবনু ইয়াকূবকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে এ হাদীস বর্ণনা করে শুনান। এ সময় তিনি রোগশয্যায় ছিলেন এবং আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৭৬২,ইসলামিক সেন্টার ৭৭৪)

(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭৬৪)


মূল কথা হল সালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা শেষ নবী (সাঃ) এর নির্দেশ। সাহাবী আবু হুরাইরাহ ইমামের পিছনে সালাত আদায়কালে চুপে চুপে সূরা ফাতিহা পড়ে ফেলতে বলেছেন।

আল্লাহ আমাদেরকে তার রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন:

আল্লাহ বলেন-

"..আর রসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।" (সূরা হাশর :৭)

"যে রসূলের আনুগত্য করল, সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে মুখ ফিরিয়ে নিল, আমি তাদের উপর তোমাকে প্রহরীরূপে প্রেরণ করিনি।"(সূরা নিসা:৮০)

আই ফতোয়া  ওয়েবসাইট বাংলাদেশের অন্যতম একটি নির্ভরযোগ্য ফতোয়া বিষয়ক সাইট। যেটি IOM এর ইফতা বিভাগ দ্বারা পরিচালিত।  যেকোন প্রশ্ন করার আগে আপনার প্রশ্নটি সার্চ বক্সে লিখে সার্চ করে দেখুন। উত্তর না পেলে প্রশ্ন করতে পারেন। আপনি প্রতিমাসে সর্বোচ্চ ৪ টি প্রশ্ন করতে পারবেন। এই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো আমাদের ফেসবুকেও শেয়ার করা হবে। তাই প্রশ্ন করার সময় সুন্দর ও সাবলীল ভাষা ব্যবহার করুন।

বি.দ্র: প্রশ্ন করা ও ইলম অর্জনের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো সরাসরি মুফতি সাহেবের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করা যেখানে প্রশ্নকারীর প্রশ্ন বিস্তারিত জানার ও বোঝার সুযোগ থাকে। যাদের এই ধরণের সুযোগ কম তাদের জন্য এই সাইট। প্রশ্নকারীর প্রশ্নের অস্পষ্টতার কারনে ও কিছু বিষয়ে কোরআন ও হাদীসের একাধিক বর্ণনার কারনে অনেক সময় কিছু উত্তরে ভিন্নতা আসতে পারে। তাই কোনো বড় সিদ্ধান্ত এই সাইটের উপর ভিত্তি করে না নিয়ে বরং সরাসরি স্থানীয় মুফতি সাহেবদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

Related questions

...